গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে জনগণের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রচলিত ভোট ব্যবস্থায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে কোনো দল সীমিত ভোট পেয়েও অধিকাংশ আসনে জয়ী হয়, আবার অন্য কোনো দল বেশি ভোট পেয়েও সংসদে প্রায় অনুপস্থিত থাকে। এমন বৈষম্য গণতন্ত্রের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই অসাম্য দূর করতে বিশ্বের বহু দেশ বেছে নিয়েছে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি।
এই পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দল বা জোট যত শতাংশ ভোট পায়, তত শতাংশ আসন পায় সংসদে। ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত সংসদ যেখানে সকল মতের প্রতিনিধিত্ব থাকে।
কী এই পিআর পদ্ধতি?
উইকিপিডিয়ার ব্যাখ্যায়, আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা হলো এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে ভোটারদের রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট পাওয়ার হারের অনুপাতে। অর্থাৎ কোনো দল যদি ১০% ভোট পায়, তাহলে তারা সংসদের মোট আসনের প্রায় ১০% পাবে। এতে জনগণের রায় অধিক সঠিকভাবে সংসদে প্রতিফলিত হয়।
কেন প্রয়োজন পিআর পদ্ধতির?
বাংলাদেশসহ অনেক দেশে প্রচলিত আছে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (FPTP) পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে যে দল বেশি আসনে জয় পায়, তারা সরকার গঠন করে—ভোটের মোট সংখ্যা বা শতাংশ নয়। এ কারণে ভোটের শতাংশ ও আসনের সংখ্যার মাঝে বড় পার্থক্য তৈরি হয়।
কিছু বাস্তব পরিসংখ্যান:
- ২০০১ সালের নির্বাচন:
- বিএনপি পেয়েছিল ৪০.৮৬% ভোট → ১৯৩টি আসন
- আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০.২২% ভোট → মাত্র ৬২টি আসন
(তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)
- ২০০৮ সালের নির্বাচন:
- আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪৮.০৪% ভোট → ২৩০টি আসন
- বিএনপি পেয়েছিল ৩২.৫০% ভোট → মাত্র ৩০টি আসন
(তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)
এই বিপরীতমুখী ফলাফল দেখায় যে, প্রচলিত পদ্ধতিতে ভোটের প্রতিফলন সব সময় সুষ্ঠু বা ন্যায্য হয় না। পিআর পদ্ধতি চালু থাকলে এই ধরনের বৈষম্য অনেকটাই হ্রাস পেত।
বাস্তব উদাহরণ
ধরা যাক, একটি আসনে চারটি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। একজন প্রার্থী পেয়েছেন ২৫% ভোট—অন্য তিন প্রার্থী মিলে পেয়েছেন ৭৫% ভোট। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে সেই ২৫% ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীই বিজয়ী হবেন। এতে বাকিদের, অর্থাৎ ৭৫% ভোটারের রায় কার্যত অনুপস্থিত থেকে যায়। এটি জনমতের অপচয়।
পিআর পদ্ধতির ইতিহাস ও বৈশ্বিক প্রসার
- ১৮৯৯ সালে প্রথম বেলজিয়ামে পিআর পদ্ধতি চালু হয়।
- বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি, অর্থাৎ ৫৪% দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে।
- উন্নত দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি’র ৩৬টি দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০% দেশ পিআর ভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা করে।
পিআর পদ্ধতির বিভিন্ন ধরন
১. মুক্ত তালিকা পদ্ধতি: ভোটাররা নির্ধারণ করেন তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের মধ্যে কারা নির্বাচিত হবেন।
২. বদ্ধ তালিকা পদ্ধতি: দল নিজে ঠিক করে দেয় কে হবেন সংসদ সদস্য।
৩. মিশ্র পদ্ধতি: কিছু আসনে প্রচলিত পদ্ধতিতে এবং কিছু আসনে পিআর ভিত্তিতে নির্বাচন হয়।
বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতির আলোচনা
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে কিছু রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতি চালুর পক্ষে মত দিয়েছে। যদিও এটি এখনো কার্যকর হয়নি, কিন্তু দিন দিন এই পদ্ধতি নিয়ে আগ্রহ ও আলোচনা বাড়ছে।
উপসংহার
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা শুধু রাজনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাই করে না, এটি গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত করে তোলে। নির্বাচনী ব্যবস্থায় জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন নিশ্চিত করতে এবং সব রাজনৈতিক মতাদর্শের সংসদে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এখনই সময়—বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য পিআর পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবার।