প্রসঙ্গ: চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া – সময়ের দাবি নাকি দেশবিক্রির চক্রান্ত?

আপনি হয়তো অবাক হবেন, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, গত পনেরো বছরে এদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে প্রায় ২.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে! আর অপচয়ের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে প্রায় ২.৮০ লক্ষ কোটি টাকা। মোট প্রকল্প বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশই লুটপাট এবং অপচয় হয়েছে!

এখন প্রশ্ন হলো, এসব উন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্ব কারা পেয়েছিল? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের কার্যক্রম কেমন ছিল?

  • প্রকল্পের খরচ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ লুটপাট।
  • কাজ সম্পন্ন না করেই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বিল তুলে নিয়েছে।
  • অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প গ্রহণ।
  • প্রকল্পের সময় বারবার বাড়িয়ে বাজেটের অযথা বৃদ্ধি।
  • প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশে প্রতিযোগিতাহীনভাবে কাজ প্রদান।
  • ঘুষ দিয়ে কাজ আদায়, ফলে মানহীন প্রকল্প বাস্তবায়ন।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক: দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১,৮৫২ কোটি টাকা। দু’বার সংশোধনের পর এর ব্যয় দাঁড়ায় ১১,৩৩৫ কোটি টাকা—মূল বাজেটের চেয়ে ৫১২ শতাংশ বেশি! এই অস্বাভাবিক খরচ বৃদ্ধি কি আসলেই স্বাভাবিক?


বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলোচনা:
সম্প্রতি ইন্টেরিম সরকার ঘোষণা দিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়ন, ম্যানেজমেন্ট ও অপারেশন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়া হবে। সরকারের বক্তব্য, এটি করা হবে FDI (Foreign Direct Investment) এর আওতায়। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে—অনেকেই একে দেশবিক্রির চক্রান্ত বলে আখ্যায়িত করছেন।

তবে বাস্তবতা কি বলে?

গত পনেরো বছরে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বন্দরের যত প্রকল্প হয়েছে, সেখানে কী পরিবর্তন এসেছে? শূন্য
গভর্ন্যান্সে জবাবদিহিতা এসেছে? আসে নাই
দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে? পায় নাই
নির্বাচিত সরকার এলে এই চর্চা বন্ধ হবে? হবে না


আন্তর্জাতিক উদাহরণ:
বিদেশি প্রতিষ্ঠান দ্বারা বন্দরের উন্নয়ন শুধু আমাদের কথায় নয়, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত:

  • গ্রীসের Piraeus বন্দর পরিচালনা করছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান।
  • বেলজিয়ামের Antwerp বন্দর দেখাশোনা করছে আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরের কোম্পানি।
  • জিবুতির গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর পরিচালনা করছে DP World।
  • ওমানের Salalah বন্দর চালাচ্ছে ডেনমার্কের APM Terminals।
  • মালয়েশিয়ার Tanjung Pelepas বন্দর উন্নত করছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান।
  • পেরুর Chancay বন্দর অপারেট করছে COSCO শিপিং কর্পোরেশন।

এসব বন্দরে বিদেশি ম্যানেজমেন্ট আসার পর কার্যক্ষমতা বেড়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, সরকারি আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে


ফলে প্রশ্ন থেকে যায়:
আমরা কি চট্টগ্রাম বন্দরের ম্যানেজমেন্ট আবারও দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে অব্যবস্থাপনা, লুটপাট ও অদক্ষতার পুনরাবৃত্তি চাই, নাকি পেরু, মালয়েশিয়া, গ্রীস, বেলজিয়ামের মতো আধুনিক, সুশৃঙ্খল ও আন্তর্জাতিক মানের বন্দরে পরিণত করতে চাই?

সিদ্ধান্ত আপনার:
দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুনরায় হাজার কোটি টাকার হরিলুটের বন্দোবস্ত করবেন, নাকি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আধুনিক বন্দর গড়ে তুলবেন?

ভবিষ্যতের চট্টগ্রাম বন্দর—অব্যবস্থাপনার প্রতীক, নাকি দক্ষিণ এশিয়ার বিজনেস হাব?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *